প্রোটিয়া বধ দিয়ে শুরু করায় প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া মোটেও অমূলক নয়। বিশ্ব ক্রিকেটের কঠিন দলগুলোর একটি দক্ষিণ আফ্রিকা। এমন একটা দলকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপের অভিযাত্রা শুরু হলে আশার পালে হাওয়া লাগবেই। কিন্তু প্রতিকূল বাতাসে আগুন জ্বালাতে গেলে জ্বলতেও পারে কিংবা নিভতেও পারে। কাজটা তো সহজ নয়। নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ আজ পর্যন্ত কামিয়াব হতে পারেনি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ তেমন শক্তিধর দলও নয়।
তার
পরও ২০১৯ বিশ্বকাপে জ্বলে উঠেছিল আশার পিদিম। শেষ পর্যন্ত জ্বলতে জ্বলতে তা নিভে যায়।
তবে বিশ্বকাপের সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত
একটা আশা কিছুতেই ছাড়তে পারিনি। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি, বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও এ
দেশের এক কৃতী সন্তানের
বিশ্বকাপের সেরা না হওয়ার কারণ
নেই। তার মতো অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বিশ্বকাপের ইতিহাসে আর কে দেখিয়েছেন?
প্রতিটি ম্যাচে ব্যাট হাতে এমন ধারাবাহিকতা ভাবাই যায় না। দল যে তিন
বার জিতেছে, তিন বারই তিনি ‘প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ’। দল হারলেও
তার ব্যাট ঠিকই হেসেছে। ৮ ম্যাচ খেলে
৬০৬ রান এবং ১১ উইকেট। বিশ্বকাপে
এমন রেকর্ড আর কারো নেই।
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের রোহিত শর্মার সংগ্রহ ছিল ৯ ম্যাচে ৬৪৮
এবং অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নারের ১০ ম্যাচে ৬৪৭
রান। স্বভাবতই ‘প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ’
হওয়ার দাবিদার ছিলেন সাকিব আল হাসান। দল
চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও ১৯৯২
সালে নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো, ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনার, ২০০৩ সালে ভারতের শচীন টেন্ডুলকার যেভাবে মহিমান্বিত হয়ে আছেন, তেমনিভাবে থাকার কথা ছিল সাকিবেরও। অথচ ‘প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ’
নির্বাচিত করা হয় নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক
কেন উইলিয়ামসনকে। এটা কি ফাইনালে হেরে
যাওয়ার সান্ত্বনা পুরস্কার? নতুবা উইলিয়ামসনের সংগ্রহ ১০ ম্যাচে ৫৭৮
রান ও ২ উইকেট।
ব্যাটিং গড়েও তার অবস্থান ছিল সাকিবের পেছনে। যদিও নানান কিছু বিবেচনায় নিয়ে সেরা নির্বাচন করা হয়, তারপরও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল হওয়ার এমন একটা মোক্ষম সম্ভাবনা হাতছাড়া হওয়ায় একদমই খুশি হতে পারিনি।
আর
যা হোক, আমাদের একজন সাকিব আল হাসান আছেন,
এটা কিন্তু কম গৌরবের নয়।
তাকে আপনার পছন্দ হতে পারে কিংবা না-ও হতে
পারে। কিন্তু তার পারফরম্যান্স নিয়ে কি দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ আছে?
ক্রিকেটার হিসেবে তিনি যে ঔজ্জ্বল্য দেখিয়েছেন,
তার কি কোনো তুলনা
হয়? সব পরিসংখ্যান বাদ
দিলেও বাংলাদেশের আর কে বিশ্বসেরা
হতে পেরেছেন? তিনি ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কি না, তা
নিয়ে হরদম আলোচনা হয়। এটা নিশ্চয়ই মামুলি কোনো বিষয় নয়। তাকে ‘গড গিফটেড ট্যালেন্ট’
বললে অতিশয়োক্তি হবে না। মাঠের বাইরের নানান রকম বিতর্ক ও সমালোচনায় জড়িয়ে
পড়লেও মাঠে নামার পর তাকে সেসব
স্পর্শ করতে পারে না। ব্যাট কিংবা বল হাতে তিনি
তার ক্যারিশমা দেখিয়ে মুগ্ধ করে দেন। সাকিব যেন গল্পের সেই মেধাবী দুষ্টু ছেলে, দিনভর টই টই করে
ঘুরলেও পরীক্ষায় ঠিকই ভালো রেজাল্ট করে। এ কারণে সাকিবের
কাণ্ডকীর্তি অপছন্দ করলেও তাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। তিনি হয়ে আছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়’।
৩৭
বছরে পা রাখা সাকিব
আল হাসানের এটাই হতে পারে শেষ ওয়ান ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ।
তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন এই আসরকে রাঙিয়ে
দিতে। গত বিশ্বকাপে তিনি
যেখানে শেষ করেছিলেন, এবার সেখান থেকে শুরু করাটাই হবে তার জন্য মস্ত এক চ্যালেঞ্জ। সাফল্যের
সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারলে তার নেতৃত্বে রচিত হতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন এক অধ্যায়। বাংলাদেশের
এবারের দলটির কাছে অতীতের কৃতিত্বকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে
গড়া এই দলটির সম্মিলিতভাবে
কিংবা অনেকেরই ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝিলিক দেখানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু এ দলের ট্রাম্পকার্ড
যে সাকিব, তা আর বলার
অবকাশ রাখে না। খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ঐশ্বরিক এক ক্ষমতা আছে
তার। তা ছাড়া বাংলাদেশ
দলের তো বটেই, ক্রিকেটারদের
ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট খামতি রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রেও অনেকটাই
ব্যতিক্রম সাকিব। ম্যাচে তার কোনো রকম ভূমিকা থাকবে না, এটা তিনি যেন মেনে নিতে পারেন না। যেভাবেই হোক, কম-বেশি অবদান
রাখবেনই। তিনি অনেকটা ম্যাজিশিয়ানের মতো। লুকানো থলের ভেতর থেকে কী দিয়ে বাজিমাত
করে দেবেন, সেটা বোধকরি তিনি নিজেও জানেন না। তার তুরুপের তাস হতে পারে ব্যাট, বল বা অলরাউন্ড
নৈপুণ্য। সে যা হোক,
আমরা সাকিব আল হাসানের ভেলকি
দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখা:
দুলাল মাহমুদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন